জমি ক্রয় বিক্রয়ে করণীয়
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। এদেশের মোট আয়তন
এক ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটার।
১৮ কোটি জনসংখ্যা পূর্ণ বাংলাদেশের মাথাপিছু জমির পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত।
এদেশে মাথাপিছু জমির পরিমাণ প্রায় ৩০ একর।
এর মধ্যে রয়েছে বাড়িঘর, নদ-নদী পাহাড়পুর, বন জঙ্গল রাস্তাঘাট শিল্প কারখানা,
শহর, ইত্যাদি, দেশের শতকরা ২৫ ভাগ আবাদি জমি মাত্র ২ শতাংশ লোকের মালিকানায়,
জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ২০.৮৩% এবং মোট শ্রমশক্তির ৪৮.১০% কৃষক,
ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের চাষযোগ্য ভূমি জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল।
জনসংখ্যা অত্যধিক চাপের কারণে জমির চাহিদা বেড়েই চলেছে
জনসংখ্যা অত্যধিক চাপের কারণে বাংলাদেশের সব ধরনের জমির চাহিদা বেড়েই চলেছে।
কাজেই বাড়ি ঘর নির্মাণ করার জন্য এখানে জমি পাওয়া বেশ কষ্টকর।
বিশেষ করে শহরাঞ্চলে আবাসিক সংকট নিরসনের জমি পাওয়া গেলেও তার দাম অনেক বেশি,
এমত অবস্থায় দালাল বা প্রতারক চক্র এসে কোন আগ্রহী ক্রেতা কে সস্তায় ভালো জমির খবর দেন।
তখন জমিনটা যাতে হাতছাড়া না হয় তার জন্য ক্রেতা দ্রুত বায়না করে বিক্রয় মূল্য পরিশোধ করে জমি দখল করতে যান।
জমি দখল করতে গিয়ে অনেক সময় ক্রেতা দেখেন যে,
১ বিক্রেতা ওই জমির প্রকৃত মালিক হিসেবে ছিলেন না
২ ওই জমি নিয়ে অন্য অংশীদারদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে
৩ বিক্রেতা ইতিপূর্বে বারবার জমি বিক্রয় করার তথায় তার বিক্রিযোগ্য কোন সত্য ছিল না
৪ ইহা অর্পিত সম্পত্তি
৫ সরকার কর্তৃক হুকুমদখল হয়েছে,
৬ যে ওয়ারিশ সূত্রে বিক্রেতা মালিকানা দাবি করছে তা উপযুক্ত আদালত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়নি
৭ ওয়ারিশ সূত্রে বিক্রেতা মালিকানা দাবি করছে তা উপযুক্ত আদালত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়নি এমত অবস্থায় ক্রেতার মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা।
দালাল বা প্রতারক চক্র ইতিমধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে, সরল কেতা জমি উদ্ধারের জন্য দেওয়ানী আদালতের আশ্রয় নেন,
দীর্ঘকাল মামলায় হাজিরা দিতে দিতে মামলা চূড়ান্ত হওয়ার আগেই ক্লান্ত ও বিরক্ত ক্রেতাকে সকলে নির্বুদ্ধিতার জন্য অপবাদ দেন।
প্রবাসী অধ্যুষিত অনেকেই জমি কেনার জন্য দালালের মাধ্যমে
প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের অনেকেই জমি কেনার জন্য দালালের মাধ্যমে সস্তার ফাঁদে পা দেয়। সুদুর বিদেশ হতে দেশে প্রবর্তনকারী ব্যক্তিরা
এবং সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তা সীমিত সামর্থ্য কারণে কর্মকর্তা ও
কর্মচারীগণ অনেক সময় সস্তায় জমি কেনার সুযোগ এবং অনেক সময় সস্তায় কিনে দীর্ঘকাল ঝামেলায় ভোগে।
আবার অনেক সময় বিরোধপূর্ণ জমি উদ্ধারের জন্য কোন কোন পক্ষ সন্ত্রাসী ও ভাড়া করে মাস্তান এর ব্যবহার করে, ফলে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়।
দাঙ্গা-হাঙ্গামা ফলে অনেকের ফুল ও যখন, বিরোধপূর্ণ জমি দখলে মানুষের জীবন ও সম্পদ বিনষ্ট হয়, এভাবে জমি দখল করতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির
চরম অবনতি হয় এর জন্য দায়ী ঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে সমস্যাপূর্ণ জমি ক্রয় করা।
ভূমি মালিকানা উৎস
ভূমি মালিকানা অনেকাংশে ভূমি মালিকানা উৎস সাথে জড়িত মালিকানার উন্মুক্তভাবে হয়ে
থাকে যথা উত্তরাধিকার সূত্রে, বিক্রয় করায় সূত্রে, ভূমি প্রাপ্তি, নিলাম করায় সূত্রে, স্বীকৃতি ও পন্তি সূত্রে,
আদালতের রায়, ভূমি অধিগ্রহণ মূলে, দান্স, ওয়াকফ, দেবা, উইল ইত্যাদি সূত্রে, বন্ধকী দলিল সূত্রে, ১৯৫০ সালের
জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ৮৬,৮৭,৮৯,৯১, ৯২,৯৩,৯৪,৯৫,৯৬,৯৭,১১৭,১৪৩,১৪৪ ধারা মূলে।
জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতাসাধারণের কর্তব্য
জমি ক্রয়ের পূর্বে ক্রেতা কর্তৃক কিছু তথ্য যাচাই করে দেখা অবশ্যক
জমি বিক্রেতার প্রকৃত মালিকানা স্বত্ব আছে কিনা, মালিকানার প্রমাণ হিসেবে বিক্রেতার নাম এর
সর্বশেষ জরিপের এস এ রেকর্ড অথবা আর এস রেকর্ড আছে কিনা, রেকর্ড/ খতিয়ানে মূল কপি সত্যায়িত কপি
দেখে নিশ্চিত হতে হবে, বিক্রেতা যদি কড়াইশুঁটির জমির মালিক হয়ে থাকে তাহলে তার নামের মিউটেশন বা
নামজারি হয়েছে কিনা, বিক্রি প্রস্তাবিত জমি দখল যাচাই খাজনা দাখিলা যাচাই করা, বিক্রি প্রস্তাবিত জমির দাগ
নম্বর এবং খতিয়ান নম্বর জেলা রেকর্ড রুম এ রেকর্ড এবং উপ সহকারী ভূমি অফিসে রেকর্ড যাচাই করে জমির মালিকানা সূত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।
অনেক সময় অসাধু দালাল ও ভূমির মালিক সরোজমিনে জমি দেখান এবং রেজিস্ট্রি করার সময় অন্য দাগ নম্বর রেজিস্ট্রি করে দেন, এ অবস্থা হতে
পরিত্রান পেতে হলে রেজিস্ট্রি করার পূর্বে রেকর্ড, নকশা ও সরোজমিন দাগ নম্বর শক্ত করতে হবে, কৃষি জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে রেকর্ডীয় মালিকানায় অংশীদারগণ আগ্রহ করার অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।
সুতরাং অংশীদারদের সম্মতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে, দখল মালিকদের জমি করায় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, এতে জমি দখলের জন্য দাঙ্গা ফ্যাসাদ এবং মামলা-মোকদ্দমায়
জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বাকি দেওয়ার উদ্দেশ্য জমির বাজারমূল্য অপেক্ষা কম মূল্য নির্ধারণ করে দলিল রেজিস্ট্রি করলে আইনে ৬৪ ধারা মোতাবেক
ক্রেতা/ বিক্রেতার শাস্তি হতে পারে, মালিকানা নিয়ে বিরোধ আছে এমন জমি করলে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে,
বাজারমূল্য চেয়ে অনেক কম দামে জমি বিক্রয় প্রস্তাব হলে তার মধ্যে সমস্যা চিহ্নিত থাকার সম্ভাবনা বেশি, শহর ও শহরতলীতে বিক্রির
জন্য প্রস্তাবিত জমি সরকারকর্তৃক ইতিপূর্বে অধিগ্রহণ হয়েছে কিনা অথবা অধিগ্রহণের প্রস্তাবে দিন কিনা তা সংশ্লিষ্ট অফিস হতে যাচাই করে দেখা অবশ্য।
সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পরীক্ষা করে যাচাই করার জন্য অবশ্য হলে ভূমি বিষয়ে অভিজ্ঞ, সৎ ও নিষ্ঠাবান আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উচিত।
কোন জমি বিক্রির পর নামজারি করার পূর্বে যদি একাধিকবার বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তরিত হয়ে থাকে তা হলে সংশ্লিষ্ট সকল ভুয়া দলিল পরীক্ষা করে
মৌজার নাম, ক্রেতা/ বিক্রেতা খতিয়ান ও দাগ নম্বর পরীক্ষা করে সর্বশেষ বিক্রেতার মালিকানা স্বত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ড অফিস অথবা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় হতে সুচি, খতিয়ান, মৌজা ম্যাপ, জে এল নং, রেকর্ড, খাজনা, নামজারি, জরিপ সংক্রান্ত
তথ্য এবং জমির প্রকৃত জানা যাবে, জমির খাজনা/ ভূমি কর আদায় নিলাম হয়েছে কিনা তা যাচাই করা অবশ্য, জমি সিকস্তি হওয়ার কারণে মালিকানা বিলুপ্ত
হয়েছে কিনা তা যাচাই করা অবশ্যক, সংশ্লিষ্ট জমি সরকার বা অন্য সংস্থাকে ঋণ গ্রহণের দেওয়া আছে কিনা তা যাচাই করা অবশ্যক।
বিক্রি প্রস্তাবিত জমিতে কোন বিরোধ মামলা-মোকদ্দমা আছে কিনা তা পার্শ্ববর্তী মালিকদের নিকট হতে অনুসন্ধান করে যাচাই করা যেতে পারে।
জমি ক্রয় করার পর ক্রেতা অর্থাৎ মালিকের কর্তব্য
জমি ক্রয় করার পর ক্রেতা অর্থাৎ মালিকের কর্তব্য, সীমানা নির্ধারণ এবং জমির ব্যবহার
তথা চাষাবাদ বাড়ি ঘর নির্মাণ করা, রেজিস্ট্রি অফিস হতে মূল দলিল গ্রহণ করা, মূল দলিল
টপ দিতে বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে দলিলের সার্টিফাইড কপি নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
মিউটেশন/ নামজারি করার জন্য সহকারী কমিশনার ভূমি অফিসে দলিলের সত্যায়িত কপি
নির্ধারিত ফিস জমা দিয়ে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে মিউটেশন/ নামজারি করানোর ব্যবস্থা করা।
নামজারি মঞ্জুর বলে আদেশ করতে সার্টিফাইড কপি এবং নতুন সার্টিফিকেট গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা, মিউটেশন মোতাবেক জমির খাজনা বা ভূমি
উন্নয়ন কর নিয়মিত পরিশোধ করার ব্যবস্থা করা, জমি ক্রয় করার পর ও বিক্রেতার দখলে রাখা অত্যন্ত বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ,
কারণ অসাধু মালিক তার জন্য ক্রেতার নিকট বিক্রি করার সুযোগ থাকে, নামজারি না করলে মালিক কর্তৃক পুনরায় জমি বিক্রয় করার সুযোগ থাকে,
মালিকানা প্রমাণের জন্য সাধারণত চারটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে, দলিল সঠিক আছে কিনা, জমি দখলে আছে কিনা, দাখিলা অর্থাৎ খাজনা দেয় কিনা,
খাজনা দেওয়ার পূর্ব শর্ত হলো মিউটেশন বা নামজারি এবং, খতিয়ান ও পর্চা মধ্যে মিল আছে কিনা, নিয়মিত ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করলে
জমির নিলাম হয়ে যেতে পারে, ভালোভাবে সীমানা চিহ্নিত করে না রাখলে অন্যরা অনধিকার প্রবেশ করার সুযোগ পাবে,
ভূমি মালিকের দায়িত্ব ভূমির খাজনা/ পর নিয়মিত পরিশোধ করা, জমির ব্যবহার তথা চাষাবাদ বা অন্য কার্যক্রমে ব্যবহার রক্ষণাবেক্ষণ করা,
বাংলাদেশের প্রায় ৭০% লোক কোন না কোনভাবে ভূমির উপর নির্ভরশীল, এদেশে ভূমি একটি দেশ সংবিধান ও স্থিতিশীল, বিভিন্ন কারণে ভূমি বিরোধ সৃষ্টি হয়,
প্রধান কারন গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, যৌথ পরিবারের মধ্যে ভাগ বন্টন সংক্রান্ত বিরোধ, ক্রয়কৃত জমির প্রকৃত মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতা,/ত্রুটি পরাজিত জমির দলিল সঠিকভাবে রেজিস্ট্রি না করা,
ভূমি রেকর্ড সংগ্রহ জটিলতা/ ত্রুটি, পৈত্রিক সম্পত্তি বন্টনের স্বচ্ছতার অভাব, যৌথ পরিবারের বিশেষভাবে মেয়ে সন্তানদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির যথাযথ বর্ণনা করা ইত্যাদি।
আদালতে বিচার কার্য সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়
জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ দেওয়ানী আদালতে নিষ্পত্তিযোগ্য দেওয়ানী আদালতে বিচার কার্য সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়
যার ফলে সম্বুদ্ধ ব্যক্তিবর্গ নিজেরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জমি দখল নিতে চেষ্টা সচেষ্ট হন,
ফলশ্রুতিতে জমির বিরোধ কে কেন্দ্র করে এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা সহ শান্তি ভঙ্গের আশঙ্কা দেখা দেয়,
দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রায় ৬০% ফৌজদারি মামলা ভূমি সংক্রান্ত ঘটনা ঘটনার জের হিসেবে হয়ে থাকে,
সুতরাং জমি ক্রয় বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সকলের অধিক যত্নবান ও সতর্ক হওয়া উচিত।